রমজান আসার সাথে সাথে, আমরা পরিবার ও বন্ধুদের সাথে আমাদের রোজা পালনের অপেক্ষায় আছি। এই সময়টিকে আমরা ৩০ দিনের জন্য উদযাপন করি। এই সময় বেশিরভাগ বাংলাদেশীদের মধ্যে জীবন যাত্রার একটি পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়, যেমন-অনেকেই রোজা রেখে কম শারীরিক পরিশ্রম করে আর একই সাথে উচ্চ ক্যালোরিযুক্ত খাবার খাদ্য তালিকায় যোগ করেন। আমাদের মধ্যে কেউ কেউ বুঝতেই পারেন না যে, রোজা রাখা (ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত খাদ্য ও পানীয় থেকে বিরত থাকা) আমাদের জন্য উপকারী হতে পারে যদি আমরা একটি স্বাস্থ্যকর এবং সুষম খাওয়ার প্যাটার্ন বজায় রাখি। বিভিন্ন প্রমাণপত্র থেকে জানা যায়, কিছু সাধারণ নিয়ম মেনে চললে আমাদের পক্ষে ওজন কমানো, আমাদের রক্তচাপ এবং কোলেস্টেরলের মাত্রা কমিয়ে আনা সম্ভব।
রোজা কীভাবে শরীরের উপর প্রভাব ফেলে?
গ্লুকোজ হলো আমাদের শরীরের শক্তির প্রধান উৎস যা আমরা প্রধানত কার্বোহাইড্রেট থেকে পাই। এটি আমাদের মস্তিষ্ক, পেশী এবং টিস্যুগুলিকে কাজ করার জন্য শক্তির যোগান দেয়। কিন্তু অতিরিক্ত কার্বোহাইড্রেট লিভার এবং পেশীগুলিতে জমা হয় যা এক সময় চর্বিতে পরিণত হয়। শরীর আসলে শেষ খাবার গ্রহন করার সময় থেকে পরবর্তি আট ঘন্টা পরে রোজা মোডে প্রবেশ করে। যখন শরীর জমিয়ে রাখার মত গ্লুকোজটি পুনরায় পূরণ করে, তখন এটি শক্তির জন্য চর্বি পোড়াতে শুরু করে, তাই আমাদের মধ্যে কারো কারো ওজন কমে যায়। এটা মনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ যে শরীর পানি সঞ্চয় করতে পারে না; তাই কিডনি রোজা কালীন সময় কমে যাওয়া পানির অনেকখানি সংরক্ষণ করার চেষ্টা করে। ক্লান্তি এবং ডিহাইড্রেশন রোধ করার জন্য সেহেরি এবং ইফতারের মধ্যে সুষম পুষ্টি এবং হাইড্রেশন দিয়ে শরীরকে পুনরায় পূরণ করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
সেহেরি ও ইফতারের জন্য কী খাবেন এবং পান করবেন
আপনাকে প্রধান পুষ্টি উপাদানগুলির সাথে আপনার ইফতার এবং সেহেরির ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে এবং বিভিন্ন প্রকার খাদ্য তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে:
– জটিল কার্বোহাইড্রেট (পুরো শস্য দানা-ওটস, বার্লি, ব্রাউন ব্রেড অ্যান্ড রাইস, ফল ও শাকসবজি, শিম) শক্তির দীর্ঘস্থায়ী উৎসের জন্য,
– ভিটামিন এবং খনিজ, ফাইবার এবং হাইড্রেশন জন্য পানি সমৃদ্ধ ফল এবং শাকসব্জী (উদাহরণস্বরূপ- তরমুজ, শসা, টমেটো, লেটুস)
– ক্যালসিয়াম, রাইবোফ্লাভিন, আয়োডিনের জন্য কম চর্বিযুক্ত দুধ (কম চর্বিযুক্ত দই, দুধ)
– প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার (মাংস, মাছ, ডিম, শিম, দুগ্ধ) পেশী ভর বজায় রাখা ও
পুষ্টির জন্য অল্প পরিমাণে স্বাস্থ্যকর ফ্যাট (জলপাই তেল, বাদাম, অ্যাভোকাডো, বীজ) বেশ কার্যকারী।
সেহেরি- এই সময়ে হালকা খাবার বেছে নেওয়া ভালো, একই সাথে বিভিন্ন প্রকার পুষ্টি মানের দিকে খেয়াল দিতে হবে। সম্পুর্ন শস্য দানার বিভিন্ন জাত এবং তরল সমৃদ্ধ খাবারগুলি খাদ্য তালিকার জন্য বেছে নিন, এগুলো আপনাকে দীর্ঘ সময় ধরে পুষ্টির যোগান দেবে এবং আপনাকে হাইড্রেটেড রাখবে।
ইফতার- আপনি ঐতিহ্য অনুসারে ১ থেকে ২ টি খেজুর দিয়ে আপনার রোজা ভাঙতে পারেন, মনে রাখবেন খেজুরে রয়েছে ফাইবার এবং পটাসিয়ামের উৎস, একই সাথে এটি ক্যালোরি সমৃদ্ধ। ইফতার আস্তে-ধীরে খাওয়া ভালো কারণ খুব দ্রুত খাওয়ার ফলে অম্বল বা পাকস্থলিতে ফোলাভাব হতে পারে।
হাইড্রেশন- ডিহাইড্রেশন এবং কোষ্ঠকাঠিন্য রোধ করতে ইফতার থেকে সেহেরি পর্যন্ত ১.৫-২ লিটার তরল পান করুন। রোয়া রাখার ফলে আপনার পানীয় গ্রহনের প্রয়োজনীয়তা পূরণ করুন, বিরতিতে ধীরে ধীরে চুমুক দিন, খুব দ্রুত পান করা ঠিক নয় কারন পাকস্থলিতে ফোলাভাব সৃষ্টি করতে পারে। অতিরিক্ত ক্যালোরি যোগ না করেই পানি আপনাকে হাইড্রেট করে। দুধ এবং ফল ভিত্তিক পানীয় চিনি ছাড়াই গ্রহণ করা ভালো।
যে খাবারগুলো এড়িয়ে চলবেন
লবণ, মশলা এবং সিজনিংস- লবণ এবং মসলাযুক্ত খাবার (আচার, জলপাই, ফ্রাই) এড়িয়ে চলা ভালো কারণ তারা শরীর থেকে পানি শোষণ করে, অম্লতা এবং তৃষ্ণা বাড়ায়।
চিনি, প্রক্রিয়াজাত খাবার এবং ডুবো তেলে ভাজা খাবার- পুষ্টি কম, ওজন বৃদ্ধি, বদহজম এবং তৃষ্ণাকে বাড়িয়ে তোলে।
ক্যাফেইন- চা এবং কফিতে মূত্রবর্ধক উপাদান রয়েছে। অধিক গ্রহণ শরীর থেকে দ্রুত জল হারাতে প্রভাবক হিসেবে কাজ করে।
কার্বনেটেড পানীয়– কার্বন পেটে ফাঁপা ভাব সৃষ্টি করে, পেট ভরে আছে এমন অনুভূতি সৃষ্টি করে এবং শরীরকে তরল গ্রহণ করতে বাধা দেয়।
ঠান্ডা তরল- ইফতারের শুরুতে বরফযুক্ত ঠান্ডা তরল পান করা হজম দক্ষতা কমিয়ে দেয় যার ফলে হজমের সমস্যা দেখা দেয়। যে কোন পানীয় প্রথমে হালকাভাবে ঠান্ডা করুন এবং ধীরে ধীরে এটি পান করুন।
যে ব্যক্তি কোন শারীরিক সমস্যায় ভুগছেন বা গর্ভাবস্থায় আছেন, বুকের দুধ খাওয়ানো, ডায়াবেটিস সহ যে সকল রোগের জন্য নিয়মিত ওষুধ গ্রহন করছেন এমন ব্যক্তির রোজা রাখার আগে ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করা উচিত।
তাজরিন মল্লিক (আরডি)
BSc Dietetics and Nutrition (UK)
Grid (National Kidney Foundation, USA)
Clinical Dietitian, National Kidney Foundation and Research Institute
Visiting Consultant, Praava Health
No comment yet, add your voice below!