মাসিক একটি সাধারণ শরীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া হলেও বাংলাদেশে এই বিষয়ে কথা বলাটা বেশ অস্বস্তিকর। মাসিক নিয়ে আমাদের সমাজের গভীরে প্রোথিত বিধিবিধান ও বিভ্রান্তিকর তথ্য এই অস্বস্তির সূচনা করেছে। এ বিষয়ে কথা না বলার ফলেই নারী ও কিশোরীদের আত্ন-মর্যাদা, সুস্বাস্থ্য এবং লেখাপড়াতে যথেষ্ট প্রভাব পড়ে এবং তারা স্যানিটেশন সুবিধা ও পরিচ্ছন্নতার অধিকার থেকে বঞ্চিত হন। এই চুপ থাকার শেকল ভাঙ্গতে এবং মাসিকের সময় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা নিয়ে সচেতনতা তৈরী করতে প্রতিবছর ২৮ মে পালিত হচ্ছে মাসিক স্বাস্থ্য দিবস। এ বছরের প্রতিপাদ্য হলো “মোর এ্যাকশন এ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট ইন মেন্সস্ট্রুয়াল হেলথ এ্যান্ড হাইজিন নাও!”
মাসিক হলো ইউট্রাস হয়ে যোনীপথের মধ্য দিয়ে রক্ত ও মিউকোসাল টিস্যুর বের হয়ে যাবার একটি নিয়মিত প্রক্রিয়া যা সাধারণত শুরু হয় ১১ থেকে ১৩ বছর বয়েসে। এই মাসিক চক্র সাধারণত ২৮ দিন পর পর ঘটে এবং তা মোটামুটি ৫ দিন স্থায়ী হয়। এই বিষয়টাকে স্বীকৃতি দেবার জন্যই মাসিক স্বাস্থ্য দিবস পালিত হয় ২৮ মে।
স্যানিটারি ন্যাপকিনের উচ্চ মূল্যের জন্য প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসবাসকারী নারী ও কিশোরীদের মাসিকের সময় প্রচুর সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় । তাই বিনামূল্যে স্যানিটারি ন্যাপকিন বিতরণ অথবা সাশ্রয়ী মূল্য নিশ্চিতের জন্য যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত। কোভিড -১৯ মহামারিতে মাসিককালীন পরিচ্ছন্নতা বিষয়ক পণ্যের মারাত্নক অপ্রতুলতা দেখা দিয়েছে। যার ফলে সুবিধাবঞ্চিত অনেক নারীই স্যানিটারি ন্যাপকিনের বদলে পুরোনো ছেড়া কাপড় ব্যবহারে বাধ্য হচ্ছেন।
কী ভাবে মাসিক পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা যায়?
মূলত এই ৪ ধরনের স্যানিটারি পণ্য ব্যবহারের মাধ্যমে:
- স্যানিটারি প্যাডস
- ট্যাম্পন
- টিস্যু পেপার
- পেঁজা তুলা
যে সকল পরিচ্ছন্নতার চর্চা করা উচিত:
- প্রতি ৬ ঘন্টা পর পর প্যাড বদল
- ভিতরে পানি দিয়ে না ধোয়া বা ডুচিং না করা
- মল-মূত্র ত্যাগের পর পর্যাপ্ত পরিষ্কার করা
- প্রতিবার প্যাড বদলানোর পর সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে ফেলা
- যদি কাপড় ব্যবহার করতেই হয়, তবে তা ভালো ভাবে ধুয়ে ও রোদে শুকিয়ে নিবেন
- ব্যবহৃত স্যানিটারি ন্যাপকিন ফেলার আগে কাগজে মুড়িয়ে যথাযথ জায়গায় ফেলুন
অস্বাস্থ্যকর অভ্যাসের জন্য যে সকল প্রজনন বিষয়ক সমস্যা দেখা দিতে পারে:
- অপরিচ্ছন্ন বা সস্তা প্যাডের দীর্ঘ ব্যবহারের ফলে ইউরিন ইনফেকশন দেখা দিতে পারে। যার ফলাফল হিসেবে প্রস্রাবে জ্বালাপোড়া, তলপেটে ব্যথা, পিঠে ব্যথা এবং জ্বর হতে পারে
- যোনিপথে ইনফেকশন হয়ে মিউকোসাল লেয়ারে ছড়িয়ে পড়তে পারে যার ফলে জরায়ু প্রাচীর, ওভারিস, ফ্যালোপিয়ান টিউবের ক্ষতি হতে পারে। মাসিকের সময় অপরিচ্ছন্নতার কারণেই এই সমস্যা গুলো দেখা দেয়। এছাড়াও তলপেটে ব্যথা, যোনি স্রাব এবং চুলকানি হতে পারে
- বড় আকারের কাপড় বা স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার করলে দুই উরুর ঘর্ষণের ফলে সেখানে চুলকানির সৃষ্টি হতে পারে
- একই প্যাড দীর্ঘ সময় ব্যবহার করলে তাতে জমে থাকা শুকনো রক্ত থেকে অস্বস্তি হতে পারে বা দূর্গন্ধ ছড়াতে পারে
- অনেক নারীই এটা ভাবেন যে মাসিকের সময় সঙ্গম করলে গর্ভধারণ ঠেকানো যাবে। কিন্তু এটি ভুল এবং এটা আরও বেশি বিপজ্জনক কারণ এর ফলে বিভিন্ন যৌন সংক্রামক রোগ দেখা দিতে পারে। যেমন হার্পিস, হেপাটাইটিস বি সহ কিছু এসটিডি গোত্রের অসুস্থতা।
- স্যানিটারি ন্যাপকিন স্পর্শ করার পর ঠিক মতো হাত পরিষ্কার না করলে হেপাটাইটিস বি এর মতো ইনফেকশন হতে পারে
- মাসিকের সময় অপরিচ্ছন্নতার ফলে হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাসের কারণে জরায়ু ক্যান্সার হতে পারে। এই ভাইসার সঙ্গমের সময় সংক্রামিত হয়। এবং মাসিকের অস্বাস্থ্যকর বর্জ্য থেকে এই ইনফেকশন সহজেই ছড়িয়ে পড়তে পারে।
- মাসিকের সময় উচ্চ শোষণকারী ট্যাম্পন ব্যবহারের ফলে টক্সিক শক সিন্ড্রোম দেখা দিতে পারে
- ব্যবহৃত স্যানিটারি পণ্য যেখানে সেখানে ফেলে দেবার ফলে অন্যদের মাঝে হেপাটাইটিস বি এর মতো ইনফেকশন ছড়াতে পারে
এই বছর মাসিক স্বাস্থ্য দিবস এসেছে কোভিড-১৯ পরিস্থিতির মাঝে। তাই আমাদের উচিত দরিদ্র নারী ও কিশোরীদের সঠিক মাসিক পরিচ্ছন্নতার তথ্য পৌঁছে দেওয়া। যা প্রত্যেক নারী এবং কিশোরীর সুরক্ষিত, স্বাস্থ্যকর এবং বিব্রতকর পরিস্থিতি মুক্ত মাসিকের জন্য সহায়ক হবে। এছাড়াও অপরিচ্ছন্ন মাসিকের ফলে যে সকল স্বাস্থ্য ঝুঁকি তৈরির সম্ভবনা থাকে তাও কমে আসবে।
No comment yet, add your voice below!