“বোতলের দুধ শিশুর পেট ভর্তি করে, কিন্তু ব্রেস্টফিডিং তার আত্মা পূরণ করে।”

সন্তানের সাথে একজন ব্রেস্টফিডিং দেওয়া মায়ের একটি শক্তিশালী মানসিক এবং শারীরিক বন্ধন গড়ে ওঠে। প্রসব পরবর্তী সময়ে নতুন মাকে তার প্রসববেদনা কাটানোর সময় দিতে এবং ব্রেস্টফিডিং শুরু করার জন্য একজন সাহায্যকারী ব্যাপকভাবে সহায়তা করতে পারে। এবছরের ওয়ার্ল্ড ব্রেস্টফিডিং উইক (ডব্লিউবিডব্লিউ) এর থিম হল “মাতৃদুগ্ধ দান সুরক্ষায় সকলের সম্মিলিত দায়িত্ব“, যার মূল প্রতিপাদ্য হলো ব্রেস্টফিডিং কীভাবে সবার জীবন, স্বাস্থ্য এবং সুখের উৎস হয়ে ওঠে।

বিশ্ব মাতৃদুগ্ধ সপ্তাহ প্রতি বছর ১ থেকে ৭ আগস্ট পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হয় এবং এর প্রধান দুটি উদ্দেশ্য হলো শিশুদের স্বাস্থ্যের উন্নতি এবং মায়েদের ব্রেস্টফিডিং জন্য উৎসাহিত ও সহায়তা করা।

ব্রেস্টফিডিং এর জন্য অনুসরনীয়

  • শিশুর জন্মের আধ ঘন্টার মধ্যে ব্রেস্টফিডিং শুরু করা উচিৎ।
  • ৬ মাস পর্যন্ত কেবলমাত্র ব্রেস্টফিডিং যথেষ্ট (এমনকি এক ফোঁটা পানিও নয়)।
  • ৬ মাস থেকে শুরু করে ২ বছর পর্যন্ত ব্রেস্টফিডিং চালু রেখেই অন্যান্য খাবার যোগ করুন।

ব্রেস্টফিডিং এর সুবিধা

শিশুদের জন্য

  • কলোস্ট্রাম, যার মধ্যে IG A আছে। এর মধ্যে উচ্চ ক্যালোরি এবং রেচক ক্রিয়া (ল্যাক্সেটিভ) রয়েছে যা নবজাতকদের জন্য প্রথম প্রতিষেধক টিকার মত কাজ করে
  • মায়ের বুকের দুধ শিশুর জন্য পরিপূর্ণ খাবার সরবরাহ করে
  • সহজ হজম প্রক্রিয়া
  • বুকের দুধে রয়েছে ইমিউনোগ্লোবিউলিন, সেলুলার উপাদান এবং বিফিডাস ফ্যাক্টর এটি সংক্রমণ থেকে রক্ষা করে
  • মস্তিষ্ক ও বুদ্ধিমত্তা বিকাশে সহায়তা করে
  • এলার্জি থেকে রক্ষা করে
  • ডায়াবেটিস, সাডেন ইনফ্যান্ট ডেথ সিন্ড্রোম (এসআইডিএস), স্থূলতা এবং শৈশবের ক্যান্সারের হার কমায়
  • শক্তিশালী রোগ প্রতিরোধক ব্যবস্থা গড়ে তোলে
  • বুকের দুধ খাওয়া শিশু তুলনামূলকভাবে অসুস্থতা জনিত কারনে হাসপাতালে কম ভর্তি হয়

মায়ের জন্য:

  • শিশু এবং মায়ের বন্ধন দৃঢ় করে
  • যদি কেবলমাত্র ব্রেস্টফিডিং করানো হয় তাহলে তা প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে জন্মনিয়ন্ত্রণ করে
  • প্রসব পরবর্তী রক্তপাত কমায়
  • প্রসবের পর বুকের দুধ তৈরি ও আব্যাহত রাখতে ব্রেস্টফিডিং করলে, প্রতিদিন প্রায় ৫০০ অতিরিক্ত ক্যালোরি ব্যয় হয় যা দ্রুত ওজন কমাতে সাহায্য করে
  • জরায়ুর ইনভল্যুশনে সহায়তা করে
  • ডিম্বাশয় এবং স্তন ক্যান্সার, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ এবং কার্ডিওভাসকুলার রোগের ঝুঁকি হ্রাস করে

ব্রেস্টফিডিং এর বিকল্প

যদিও ব্রেস্টফিডিং শিশু এবং মা উভয়ের জন্য অত্যন্ত উপকারী। তবে কিছুক্ষেত্রে বাস্তবতা হলো অনেক মহিলা বিভিন্ন কারণে ব্রেস্টফিডিং করাতে পারেন না। তার কয়েকটি উদাহরণ হতে পারে- অতীতের ব্রেস্ট সার্জারি, কেমোথেরাপি, অনিরাময়যোগ্য অসুস্থতা, কম দুধ সরবরাহ, অথবা তাদের সন্তানের বুকের দুধের কোনও কিছুতে অ্যালার্জি রয়েছে কিনা। এক্ষেত্রে মায়েদের দোষ না দিয়ে বরং তাদের এবং তাদের শিশুর জন্য কোন পদ্ধতিগুলি সর্বোত্তম কাজ করবে তা খুঁজে বের করার জন্য গুরুত্ব দেওয়া।

ফর্মুলা ফিড একটি শিশুর মায়ের বুকের দুধের পুষ্টির বিকল্প হতে পারে। এরমধ্যে রয়েছে বেশ কয়েকটি ভিটামিন উপাদান যা নবজাতকের ব্রেস্টফিডিং এর প্রয়োজনীয়তা পূরণ করে। মিল্ক ডোনার হতে পারে অন্য একটি বিকল্প। মা এবং শিশু উভয়ের জন্য উপকারী হবে এমন সর্বোত্তম কর্মপরিকল্পনা পেতে একজন ডাক্তারের সাথে কথা বলুন।

কার্যকর ব্রেস্টফিডিং এর লক্ষণ

  • প্রতিদিন ৮ থেকে ১২ বার বুকের দুধ খাওয়ানো
  • শিশুর একদিনে প্রায় ৬ থেকে ৮ বার ডায়পার ভেজা থাকা উচিৎ
  • শিশুর প্রতিদিন সর্বনিম্ন ৩ থেকে ৪ বার অন্ত্রের নড়াচড়া (মলত্যাগ) করা উচিৎ
  • জন্মের দশম দিনের মধ্যে, শিশু তার জন্মের ওজন ফিরে পাবে

ব্রেস্টফিডিং করানোর সময় শিশুর অবস্থান এবং সংযুক্তি

ব্রেস্টফিডিং করানোর সময় শিশুর অবস্থান:

  • শিশুর পুরো শরীরকে সাপোর্ট দেওয়া
  • নিশ্চিত করুন যে শিশুর মাথা, ঘাড় এবং পিঠ সব একই সমতলে রয়েছে
  • শিশুর পুরো শরীর মায়ের মুখোমুখি হওয়া উচিৎ
  • শিশুর পেট মায়ের পেটে স্পর্শ করা উচিৎ

মায়ের স্তনে শিশুর যথাযথ সংযুক্তি

  • শিশুর মুখ প্রশস্ত ভাবে পুরোপুরি খোলা থাকবে
  • নীচের ঠোঁট বাইরের দিকে ঘোরানো থাকবে
  • শিশুর থুতনি মায়ের স্তন স্পর্শ করে থাকবে
  • বেশিরভাগ অ্যারিওলা (স্তনবৃন্তের চারপাশের ঈষৎ রঞ্জিত স্থান) শিশুর মুখের ভিতরে থাকা উচিৎ

ব্রেস্টফিডিং এর সময় মায়েদের জন্য পুষ্টি

  •  দৈনিক আট গ্লাস তরল (কমপক্ষে অতিরিক্ত ১ লিটার তরল) পান করুন
  • আয়রন সম্পূরক মাল্টিভিটামিন নিন
  • ব্রেস্টফিডিং চলাকালীন মায়েদের প্রতিদিন ৫০০+ ক্যালোরি গ্রহণ করতে হবে
  • সুষম খাদ্য খান
  • ক্যাফিনযুক্ত পানীয়গুলো এড়িয়ে চলা উচিৎ অথবা প্রতিদিন এক থেকে দুই কাপের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকা উচিৎ

কোভিড-১৯ এর সময় ব্রেস্টফিডিং

বুকের দুধ এবং ব্রেস্টফিডিং এর মাধ্যমে কোভিড-১৯ সংক্রমণ হয়েছে তা নিশ্চিত করার মতো পর্যাপ্ত তথ্য নেই। মা কোভিড-১৯ পজিটিভ হলেও ব্রেস্টফিডিং চালিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। ব্রেস্টফিডিং চলাকালীন মায়েরা কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন নিতে পারেন। ব্রেস্টফিডিং করানো মায়েরা যারা কোভিড-১৯ এমআরএনএ টিকা পেয়েছেন তাদের বুকের দুধে অ্যান্টিবডি আছে যা তাদের নবজাতকদের সুরক্ষা প্রদান করে।

মহামারীর সময় মা এবং শিশুদের নিরাপদ রাখার টিপস:

  • বুকের দুধ খাওয়ানোর সময় থ্রি ডাব্লু অনুশীলন করুন:
  • বুকের দুধ খাওয়ানোর সময় মুখে মাস্ক পড়ুন
  • শিশুকে স্পর্শ করার আগে ও পরে সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে নিন
  •  চারপাশ নিয়মিত পরিষ্কার ও জীবাণুমুক্ত রাখুন
  • আপনি অসুস্থ থাকলে বা ব্রেস্টফিড করাতে না পারলে আপনার শিশুকে নিষ্কাশিত বুকের দুধ খাওয়ানোর জন্য একটি কাপ এবং চামচ ব্যবহার করুন।
  •  মা যদি ব্রেস্টফিড করাতে অক্ষম হন তবে ফর্মুলা ফিডিং এর সময় অতিরিক্ত সতর্কতা অবলম্বন করুন।

আপনার গাইনোকোলজিস্টের সাথে কথা বলুন

আপনার শিশু এবং ব্রেস্টফিডিং সম্পর্কিত কোনো প্রশ্ন থাকলে আপনার ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করুন। যে কোনসময় যদি আপনি উল্টা বা সমতল নিপলস লক্ষ্য করেন, আপনার নিপল যদি ব্যথা করে, ব্রেস্ট ফুলে ওঠে, ব্রেস্টে ফোঁড়া অনুভব করেন, অথবা যদি পর্যাপ্ত দুধ না থাকে তবে আপনার ডাক্তারের সাথে তখনই কথা বলুন। এতে করে আপনি আপনার এবং আপনার শিশুর স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করতে সহায়তা পেতে পারেন।

ব্রেস্টফিডিং চলাকালীন মাকে সহায়তা করুন

সকল মায়েরই সাহায্যের প্রয়োজন হয় এবং তার সাথে আপনার সম্পর্ক যাই হোক না কেন, তাকে সহায়তা করার জন্য আপনি যা যা করতে পারেন:

  • নিশ্চিত করুন যে তার শক্তি বজায় রাখার জন্য পর্যাপ্ত খাবার এবং পানীয় গ্রহণ করছে
  • একে অপরের সাথে কিছু নিরবচ্ছিন্ন সময় কাটানোর চেষ্টা করুন
  •  শিশুটিকে আপনার কাছে রাখুন যাতে সে বিরতি নিতে পারে
  • শিশুর দায়িত্ব গুলোতে সহায়তা করুন, যেমন- ন্যাপি পরিবর্তন, গভীর রাতে শিশুকে নিয়ে পায়চারি করা
  • সে যেখন ঘুমায় তখন শিশু কাঁদলে, শিশুকে আপনি শান্ত করুন যাতে মায়ের ঘুম না ভাঙ্গে

একজন মাকে ব্রেস্টফিডিং করতে শেখার ক্ষেত্রে- জ্ঞান, উৎসাহ এবং সমর্থন সবই সমান গুরুত্বপূর্ণ। যদি তার ব্রেস্টফিডিং করাতে অসুবিধা হয়, তার সঙ্গী তাকে উৎসাহিত করতে পারে এবং চ্যালেঞ্জ গুলি কাটিয়ে উঠতে তাকে সহায়তা করতে পারে। ব্রেস্টফিডিং একটি দায়িত্ব যা পিতামাতা উভয়কেই ভাগ করে নিতে হবে।

Recommended Posts

No comment yet, add your voice below!


Add a Comment